Translate

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০১৭

আমি মালালা

                      
                                  ১
                   একটি মেয়ে জন্মাল

আমি যখন জন্মেছিলাম, আমার গ্রামের লোকজন মায়ের জন্য করুণা প্রকাশ করেছিল, বাবাকে কেউ অভিনন্দিত  করেনি। উষালগ্নে, যখন শেষ তারাটিও নিভে গেছিল,তখন আমি হলাম।  আমরা পাশতুনরা এটাকে শুভ লক্ষণ  বলে মানি। আমার বাবার হাসপাতালের বা ধাইয়ের ব্যবস্থা করার মতো টাকা কড়ি ছিল না, তাই এক প্রতিবেশী  আমার জন্মে সাহায্য করেছিলেন। আমার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তানটি মৃত অবস্থায় জাত হলেও আমি কিন্তু পা ছুঁড়ে,  চিৎকার করে  ভূমিষ্ঠ হলাম। আমি এমন দেশের মেয়ে যেখানে  ছেলের জন্মউদযাপনে  রাইফেল থেকে গুলি ছোঁড়া হয়, আর মেয়েদের লুকিয়ে ফেলা হয় পর্দার অন্তরালে। জীবনে তাদের ভূমিকা খাবার তৈরী আর বাচ্চার জন্ম দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ।

  যখন একটা মেয়ে জন্মায়, বেশীর ভাগ পাশতুনের কাছেই তা এক বিষাদের দিন। আমার বাবার জ্ঞাতি ভাই জিহান শের খান ইউসুফজাই ছিলেন সেই মুষ্টিমেয়দের একজন যারা আমার জন্মগ্রহন উদযাপন করতে এসেছিলেন এমন কি প্রচুর  টাকাকড়ি  উপহার দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি তার সংগে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের বংশের বিশাল কুলুজী। ডালোখেল ইউওসুফজাই আমাদের পিতামহ -প্রপিতামহ-বৃদ্ধ পিতামহের ধারানুসারে পেছনে যেতে থাকলেন এবং পুরুষের ধারাটি কেবমমাত্র দেখাতে লাগলেন। আমার বাবা জিয়াউদ্দিন অন্যান্য পুশতুন মানুষদের থেকে আলাদা ছিলেন। তিনি বংশতালিকাটি দেখে তার নামের থেকে ললিপপের মত একটা দাগ আঁকলেন, তার নিচে লিখলেন মালালা। তার জ্ঞাতি ভাই বিস্ময়বিমূঢ়  হয়ে হাসল। আমার বাবা পরোয়া করলেন না। তিনি বলতেন জন্মের পর তিনি আমার চোখের দিকে চেয়েই ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তিনি লোকজনকে বলতেন  আমি জানি এই শিশুটির মধ্যে কিছুতো আলাদা আছে। তিনি প্রায়শই তার বন্ধুদের আমার দোলনায় শুকনো ফল, মিঠাই ও মুদ্রা ফেলতে বলতেন যা আমরা সাধারণত  ছেলেদের জন্য করে থাকি।
   আমার নাম রাখা হয়েছিল আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ বীরাঙ্গনা মাইওয়ান্দের মালালা-র নামে। পাশতুনরা হল পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন উপজাতির লোকেদের মধ্য এক গৌরবান্বিত  জাতি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমরা যে নিয়ম অনুসরণ  করে জীবনযাপন করি তাকে বলে 'পাস্তুনওয়ালী' যা আমাদের সমস্ত অতিথিদের সৎকারে বাধ্য করে, এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  হল নাং বা সন্মান। একজন পুশতুনের কাছে সবচেয়ে অবাঞ্ছনীয়  বিষয় হল অখ্যাতি। লজ্জা-গ্লানি হল একজন পুশতুন মানুষের কাছে সবচেয়ে ভীতিজনক। আমাদের একটা প্রবাদ আছে সন্মান ছাড়া পৃথিবীর কোন মূল্য নেই। আমাদের নিজেদের লড়াই জাতিবৈরঅতা এত বেশী যে আমাদের জ্ঞাতির প্রতিশব্দ আর আমাদের শত্রুর প্রতিশব্দ একই- 'তার্বুর'। কিন্তু বহিরাগতরা আমাদের ভূমি দখল করতে এলে আমরা সর্বদা একত্রে বিরোধ করেছি। ১৮৮০র দ্বিতীয় এংলো  আফগান সংগ্রামের সবচেয়ে বড় লড়াই গুলির একটিতে মালালাই কিভাবে আফগান সেনাবাহিনী কে ইংরেজদের হারাতে অনুপ্রাণিত  করেছিলেন সমস্ত পুশতুন ছেলেমেয়েরা সেই কাহিনী  শুনে বড় হয়।
   মালামাই ছিলেন পশ্চিম কান্দাহারের ধূলিধূসর সমতলের ছোট্টশহর মাইওয়ান্দের এর এক মেষপালকের কন্যা।  যখন তিনি কিশোরী তখন তার পিতা ও যে মানুষটিকে তিনি বিয়ে করবেন তারা উভয়েই হাজার হাজার আফগানীদের মধ্যে তাদের দেশে বৃটিশ দখলদারির বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। মালালাই গ্রামের অন্য মহিলাদের সঙ্গে আহতদের পরিচর্যা ও তাদের জল এনে দেবার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। তিনি দেখলেন তাদের লোকেরা পরাভূত হচ্ছেন, যখন পতাকাবাহক পড়ে গেলেন তিনি তার সাদা  ওড়নাখানি উঁচু করে তুলে ধরলেন এবং দৃঢ়পদে এগিয়ে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
  'প্রিয় তরুণেরা' তিনি চিৎকার করে বললেন যদি তোমরা মাইওয়ান্দের এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাণপাত হওয়ার আগে ফের, তাহলে ঈশ্বরের শপথ কেই না কেউ তোমাদের লজ্জাকর নিদর্শন হিসাবেই ত্রাণ করবে।
  মালালাই কে অগ্নিদগ্ধ করে মারা হয়েছিল কিন্ত তার কথা ও সাহস মানুষকে যুদ্ধে ফিরবার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। তারা পুরো একটা বাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছিল, যা বৃটিশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা শোচনীয়  পরাজয় গুলির অন্যতম। আফগানেরা এত গর্বিত ছিল যে শেষ আফগান সম্রাট কাবুলের মাঝখানে একটি মাওয়ান্দের বিজয়স্তম্ভ  নির্মান করেছিলেন। হাইস্কুলে পড়ার সময় আমি কিছু শার্লক হোমস পড়েছিলাম, এবং এটা দেখে খুব হাসতাম যে, এটাই হল সেই যুদ্ধ যাতে বিখ্যাত গোয়েন্দার সহকারী  হবার আগে ডঃ ওয়াটসন আহত হয়েছিলেন। মালালাই এর মধ্যে আমরা পাশতুনেরা নিজেদের জোয়ান অফ আর্ক কে খুঁজে পেয়েছিলাম। আফগানিস্তান এর অনেক মেয়েদের স্কুল-ই তার নামে নামাঙ্কিত। কিন্তু যিনি অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ পণ্ডিত ও গ্রামের যাজক আমার ঠাকুরদা বাবার এই নামকরণ পছন্দ করেন নি। তিনি বলতেন এটা দুঃখের নাম, যার অর্থ বিষাদ তাড়িত।
       যখন আমি শিশু ছিলাম আমার বাবা পেশোয়ারের বিখ্যাত কবি রহমৎ সাহ সাইল-এর লেখা একটা গান আমাকে প্রায়শই শোনাতেন। যার অন্তিম স্তবকের শেষটা ছিল-
ও মাইওয়ান্দের মালালাই
পাশতুনদের সন্মানের সংগীত বোঝাতে আর একবার জেগে ওঠো
তোমার কাব্যময় বাণী, চারপাশের জগৎকে দুলে দিক
আমি অনুনয় করছি আবার জেগে ওঠো
আমাদের বাড়িতে যে-ই  আসত বাবা তাকে মালালাই-এর কাহিনী  বলতেন। আমি এই কাহিনী,  বাবার আমাকে শোনানো গান, কেউ আমাকে ডাকার সময় নামটির  বাতাসে ভেসে যাওয়া শুনতে ভালোবাসতাম।