Translate

মঙ্গলবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৭

স্বপ্নদের মৃত্যুকথা

... ...

ইচ্ছে হয়
কুয়াশালগ্ন ভোরে হেঁটে যাই
কোপাইয়ের পাড়ে..

পূর্ণিমা মাখামাখি সোনাঝুরি বনে
নেমে আসা স্বর্গের ঘ্রাণে ভরে নিই বুকের পাঁজর...

নিরালা দুপুরে পুর্বপল্লির পথে পথে
ঝরা পাতাদের শব্দ, শুন্যপ্রায় গেরস্থ বাগানে
পাখিদের গান, আনমনা স্রোতে বয়ে যাওয়া
কদাচিৎ  সাইকেল...
এই সব দৃশ্য শব্দ গন্ধে ডুবে যেতে...

সাধ জাগে ভরন্ত ক্ষেতের আলে
চুপচাপ শুয়ে মাখি কার্তিকের হিম...

নিভন্ত বিকেলের ডাকে পড়ে থাকা রেলপথ বেয়ে চলে যাই দূর, দুরান্তরে,
অন্ধকার ঘন হলে অজানা প্রান্তর-ঝোপ-ঝাড়ে কখন জ্বলে ওঠে অর্বুদ জোনাক-প্রদীপ
স্মৃতি ভরে এঁকে নিই...

এই সব ইচ্ছারাশি অলীক স্বপ্নবৎ
ডুবে থাকে হৃদয় কন্দরে একদিন
শতদল মেলে ফুটে ঊঠবার প্রত্যাশায়!

কিন্তু জানি,
এই সব স্বপ্নসন্ততিদের আলোর মুখ দেখে আকাশের নীল মাখা হবেনা কোনও দিন।

সুসভ্য হিংস্রতার মধ্যে নিয়ত বসবাস লব্ধ অভিজ্ঞতা হিম কণ্ঠে বলে গেছে মজ্জার গভীরে,
রাত্রির আরণ্য-আঁধারে, ভোরের কুয়াশায়, বিজন সন্ধ্যার প্রান্তরে, কিংবা প্রকাশ্য দুপুরে শতশত চলমান মৃতদের ভিড়ে, ফুটপাথে...
যে কোন স্থানে ও মুহুর্তে শাণিত শ্বদন্তে আর লোলুপ নখরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারি।

পরিপার্শ্ব তখন মূক ও বধির এবং অন্ধ-ও...

তাই সব ইচ্ছেদের  জলের গহীনে আজীবন সন্তর্পনে ঘুমঘোরে রেখে যেতে হয়!
বেপরোয়া নিশিডাক যেন না পৌছায় কানে...!
অপচয়ে অপচয়ে মেয়েবেলা ক্ষয়ে যায়
গতিহীন মৃতকল্প নদীটির মত!

সমস্ত পথ জুড়ে
কাঁটাতার বিছিয়েছে নির্মম ভয়
ওই পারে যেতে নেই
গন্ডির এপারে স্বপ্নডুবি দিঘির কিনারে থেমে যেতে হয়...    (কৃষ্টিশ্রী)

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০১৭

আমি মালালা

                      
                                  ১
                   একটি মেয়ে জন্মাল

আমি যখন জন্মেছিলাম, আমার গ্রামের লোকজন মায়ের জন্য করুণা প্রকাশ করেছিল, বাবাকে কেউ অভিনন্দিত  করেনি। উষালগ্নে, যখন শেষ তারাটিও নিভে গেছিল,তখন আমি হলাম।  আমরা পাশতুনরা এটাকে শুভ লক্ষণ  বলে মানি। আমার বাবার হাসপাতালের বা ধাইয়ের ব্যবস্থা করার মতো টাকা কড়ি ছিল না, তাই এক প্রতিবেশী  আমার জন্মে সাহায্য করেছিলেন। আমার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তানটি মৃত অবস্থায় জাত হলেও আমি কিন্তু পা ছুঁড়ে,  চিৎকার করে  ভূমিষ্ঠ হলাম। আমি এমন দেশের মেয়ে যেখানে  ছেলের জন্মউদযাপনে  রাইফেল থেকে গুলি ছোঁড়া হয়, আর মেয়েদের লুকিয়ে ফেলা হয় পর্দার অন্তরালে। জীবনে তাদের ভূমিকা খাবার তৈরী আর বাচ্চার জন্ম দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ।

  যখন একটা মেয়ে জন্মায়, বেশীর ভাগ পাশতুনের কাছেই তা এক বিষাদের দিন। আমার বাবার জ্ঞাতি ভাই জিহান শের খান ইউসুফজাই ছিলেন সেই মুষ্টিমেয়দের একজন যারা আমার জন্মগ্রহন উদযাপন করতে এসেছিলেন এমন কি প্রচুর  টাকাকড়ি  উপহার দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি তার সংগে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের বংশের বিশাল কুলুজী। ডালোখেল ইউওসুফজাই আমাদের পিতামহ -প্রপিতামহ-বৃদ্ধ পিতামহের ধারানুসারে পেছনে যেতে থাকলেন এবং পুরুষের ধারাটি কেবমমাত্র দেখাতে লাগলেন। আমার বাবা জিয়াউদ্দিন অন্যান্য পুশতুন মানুষদের থেকে আলাদা ছিলেন। তিনি বংশতালিকাটি দেখে তার নামের থেকে ললিপপের মত একটা দাগ আঁকলেন, তার নিচে লিখলেন মালালা। তার জ্ঞাতি ভাই বিস্ময়বিমূঢ়  হয়ে হাসল। আমার বাবা পরোয়া করলেন না। তিনি বলতেন জন্মের পর তিনি আমার চোখের দিকে চেয়েই ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তিনি লোকজনকে বলতেন  আমি জানি এই শিশুটির মধ্যে কিছুতো আলাদা আছে। তিনি প্রায়শই তার বন্ধুদের আমার দোলনায় শুকনো ফল, মিঠাই ও মুদ্রা ফেলতে বলতেন যা আমরা সাধারণত  ছেলেদের জন্য করে থাকি।
   আমার নাম রাখা হয়েছিল আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ বীরাঙ্গনা মাইওয়ান্দের মালালা-র নামে। পাশতুনরা হল পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন উপজাতির লোকেদের মধ্য এক গৌরবান্বিত  জাতি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমরা যে নিয়ম অনুসরণ  করে জীবনযাপন করি তাকে বলে 'পাস্তুনওয়ালী' যা আমাদের সমস্ত অতিথিদের সৎকারে বাধ্য করে, এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  হল নাং বা সন্মান। একজন পুশতুনের কাছে সবচেয়ে অবাঞ্ছনীয়  বিষয় হল অখ্যাতি। লজ্জা-গ্লানি হল একজন পুশতুন মানুষের কাছে সবচেয়ে ভীতিজনক। আমাদের একটা প্রবাদ আছে সন্মান ছাড়া পৃথিবীর কোন মূল্য নেই। আমাদের নিজেদের লড়াই জাতিবৈরঅতা এত বেশী যে আমাদের জ্ঞাতির প্রতিশব্দ আর আমাদের শত্রুর প্রতিশব্দ একই- 'তার্বুর'। কিন্তু বহিরাগতরা আমাদের ভূমি দখল করতে এলে আমরা সর্বদা একত্রে বিরোধ করেছি। ১৮৮০র দ্বিতীয় এংলো  আফগান সংগ্রামের সবচেয়ে বড় লড়াই গুলির একটিতে মালালাই কিভাবে আফগান সেনাবাহিনী কে ইংরেজদের হারাতে অনুপ্রাণিত  করেছিলেন সমস্ত পুশতুন ছেলেমেয়েরা সেই কাহিনী  শুনে বড় হয়।
   মালামাই ছিলেন পশ্চিম কান্দাহারের ধূলিধূসর সমতলের ছোট্টশহর মাইওয়ান্দের এর এক মেষপালকের কন্যা।  যখন তিনি কিশোরী তখন তার পিতা ও যে মানুষটিকে তিনি বিয়ে করবেন তারা উভয়েই হাজার হাজার আফগানীদের মধ্যে তাদের দেশে বৃটিশ দখলদারির বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। মালালাই গ্রামের অন্য মহিলাদের সঙ্গে আহতদের পরিচর্যা ও তাদের জল এনে দেবার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। তিনি দেখলেন তাদের লোকেরা পরাভূত হচ্ছেন, যখন পতাকাবাহক পড়ে গেলেন তিনি তার সাদা  ওড়নাখানি উঁচু করে তুলে ধরলেন এবং দৃঢ়পদে এগিয়ে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
  'প্রিয় তরুণেরা' তিনি চিৎকার করে বললেন যদি তোমরা মাইওয়ান্দের এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাণপাত হওয়ার আগে ফের, তাহলে ঈশ্বরের শপথ কেই না কেউ তোমাদের লজ্জাকর নিদর্শন হিসাবেই ত্রাণ করবে।
  মালালাই কে অগ্নিদগ্ধ করে মারা হয়েছিল কিন্ত তার কথা ও সাহস মানুষকে যুদ্ধে ফিরবার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। তারা পুরো একটা বাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছিল, যা বৃটিশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা শোচনীয়  পরাজয় গুলির অন্যতম। আফগানেরা এত গর্বিত ছিল যে শেষ আফগান সম্রাট কাবুলের মাঝখানে একটি মাওয়ান্দের বিজয়স্তম্ভ  নির্মান করেছিলেন। হাইস্কুলে পড়ার সময় আমি কিছু শার্লক হোমস পড়েছিলাম, এবং এটা দেখে খুব হাসতাম যে, এটাই হল সেই যুদ্ধ যাতে বিখ্যাত গোয়েন্দার সহকারী  হবার আগে ডঃ ওয়াটসন আহত হয়েছিলেন। মালালাই এর মধ্যে আমরা পাশতুনেরা নিজেদের জোয়ান অফ আর্ক কে খুঁজে পেয়েছিলাম। আফগানিস্তান এর অনেক মেয়েদের স্কুল-ই তার নামে নামাঙ্কিত। কিন্তু যিনি অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ পণ্ডিত ও গ্রামের যাজক আমার ঠাকুরদা বাবার এই নামকরণ পছন্দ করেন নি। তিনি বলতেন এটা দুঃখের নাম, যার অর্থ বিষাদ তাড়িত।
       যখন আমি শিশু ছিলাম আমার বাবা পেশোয়ারের বিখ্যাত কবি রহমৎ সাহ সাইল-এর লেখা একটা গান আমাকে প্রায়শই শোনাতেন। যার অন্তিম স্তবকের শেষটা ছিল-
ও মাইওয়ান্দের মালালাই
পাশতুনদের সন্মানের সংগীত বোঝাতে আর একবার জেগে ওঠো
তোমার কাব্যময় বাণী, চারপাশের জগৎকে দুলে দিক
আমি অনুনয় করছি আবার জেগে ওঠো
আমাদের বাড়িতে যে-ই  আসত বাবা তাকে মালালাই-এর কাহিনী  বলতেন। আমি এই কাহিনী,  বাবার আমাকে শোনানো গান, কেউ আমাকে ডাকার সময় নামটির  বাতাসে ভেসে যাওয়া শুনতে ভালোবাসতাম।

বুধবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৭

নির্জনতার সেতু

কিছু কিছু সেতু বেয়ে এখনও
জীবনের কুটিল অন্ধিসন্ধি পার হয়ে
ছোঁয়া যায়, সীমাহীন তেপান্তর পারে
সব পেয়েছির দেশ!

সেখানে সীমান্ত নেই, কাঁটাতার, মানচিত্র, রক্তচক্ষু বেয়নেট...
লাল,নীল, সবুজের ঝাণ্ডা অধ্যুষিত এলাকা দখল...
আনমনে বেপাড়ায় পা বাড়ালে
ল্যাজ নাড়া নেড়িদের ঘেউ ঘেউ  ডাক...
সেখানে পৌছতে আজও আলোকবর্ষ দেরি।

হয়ত বা নড়বড়ে,
তবু পায়ে পায়ে,
ক্ষীণতর  বিশ্বাসের আলপথ বেয়ে
একদিন নিশ্চয়
সেতুখানি হয়ে যাব পার...
অন্ধকার পর্দার ওপাশে
সমাগত স্বাগতের দেশে।

শনিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৬

ইন্ধন... ...

স্রোত-ও কখনো-সখনো দৈনন্দিন ইন্ধন বয়ে আনে..
নদীর নির্জন চরে ক্লান্ত চিতা জলে ভেসে গেলে
কোন এক নামহীন কুলে সেই সব যাপিত প্রাণের 
দহনের সহচর অর্ধদগ্ধ কিছু কাঠে... ভাঙ্গা কুঁড়েঘরে
দিনশেষে চমৎকার ভাতের আঘ্রাণ...
উদোম শিশুকে ঘরমুখো করে।

এভাবেই স্রোত 
কখনো কখনো সেতু বাঁধে ...  এক মুঠো 
অস্থি অবশেষ জুড়ে যায়  পরিত্রৃপ্ত গ্রাসে...
যে জীবন হারিয়েছে বাসা, তাই যেন ফ্যানের সুবাসে
থিতু হয়... আধো অন্ধকারে নামহীন ঝুপড়ির
আনাচে কানাচে...  

ভালোবাসা বেপরোয়া ঝাঁপ দেয়, মৃত্যু নদীর খরশান ফাঁদ
এড়িয়ে ... বারবার ... অনায়াস ফিরে ফিরে আসে...
ধুলোপায়ে, গলির গোলোক ধাঁধা ভেঙে চেনা চৌহদ্দির মাঝে, 
নুনে-ভাতে, ক্লান্ত রাতে ... প্রিয় নারীর ওম মেখে...
নিল নিঃসাড় হিমে জীবনের ইন্ধন জ্বালে...

ভূমিকম্পের প্রতি ... ...

April 25, 2015 at 3:32pm
আর একটু জোরে, বিষাক্ত শিকড়
ছড়িয়েছে অনেক গভীরে,
দু একদোলনে উৎখাত হবার নয় আজ।
হে সর্বংসহা আর কতকাল
মেনে যাবে মুখ বুজে নির্মম নির্লজ্জ
বিনাশন ... রক্ত হোরী খেলা।
দ্বীধা হও বসুমাতা, ভাঙো ভাঙো ভাঙো
প্রলয় দোলায় পুঞ্জীকৃত পাপেরপ্রাসাদ,
অন্ধ অহমিকা রাশি।
অট্টহাসে কাঁপুক ভুবন
মুক্ত কর ধ্বংস সাজে, তাণ্ডবলীলায়!
অ-সভ্যতা ভগ্ন স্তূপ উদ্ভিন্ন করে
প্রলয়ের পরবর্তী ভোরে
কোরক মেলুক দুঃসাহসী রক্তকরবী।

চরৈবেতি

তবুও বিশ্বাস...

May 17, 2014 at 12:10am
চলে যাই, চলে যেতে হয় ...অনেক সময়! 
হাতের মুঠোয় তখন নষ্ট চাঁদ গুনগুণ সুরে গেয়ে চলে
প্রপিতামহীর হারানো নক্সী কাঁথার অলীক গাথা

চলে যাই, চলে যেতে হয়... অনেক সময়
বন্ধ্যা পথ জানার পরেও, স্বপ্ন বীজ রোপণ
অনিবার্য হয়ে ওঠে

এভাবেই যেতে যেতে যেতে 
সন্ত্রস্ত সন্ধ্যার বন্ধ চোখে চোখ রেখে
পড়ে গেছি অজস্র কান্না

এভাবেই যেতে যেতে যেতে
মৃত্যুলগ্ন রাতের জঠরে নিঃশব্দ চিৎকারে
প্রতিবাদ পরিপাক হতে দেখবার পরেও 

চলে যাই, চলে যাব... অনন্ত সময়
কারন আমারই হাতে একদিন
মিলে যাবে হাজার শপথ

এভাবেই পায়ে পায়ে পায়ে
বেড়ে যাবে পথ, রক্ত-বদ্ধ গর্ভবাস শেষে
উদিত হবেই জাতক 

তাই চলি, তাই চলে যেতে হয়, তাই চলে যাব বারবার
জন্ম থেকে জন্মান্তর জুড়ে
চরৈবেতি সাধনা আমার... 

একটা বৃষ্টির কবিতা


May 27, 2014 at 11:13am
একটা বৃষ্টির কবিতাএকটা বৃষ্টির কবিতা







একটা বৃষ্টির কবিতা হয়ে যাক
ধূ–ধূ মাঠ চিরে ওঠা ইট-কাঠ-কংক্রিট
মেঘলা ক্যনভাসে হঠাৎ যখন জলছবি...

একটা বৃষ্টির কবিতা বাজুক
ঘাস ওড়নায় টলটলে মুক্তা জন্মক্ষণে
চুমুকে চুমুকে কিছু উষ্ণতা মাখা
পেয়ালা ঠোঁট ছুঁয়ে আলতো
ইশারা দিলে...

একটা বৃষ্টির কবিতা... ... ...
ফোঁটায় ফোঁটায় ছুঁয়ে দিক আমাদের
তপ্ত উঠোন! লু বাতাস স্মৃতি ভুলে
হাট করা জানালায়
ভিজে আসা শালিক যুগল
ডানার ঝাপটে একমুঠো খুশি
দশ ফুট বাই বারো ফুটে
এলোমেলো ছড়াবার পর... ...
সমস্ত গুমোট ভুলে আঙুলে-আঙুল
বৃষ্টির কবিতা এঁকে যাক!